পুঠিয়ায় গর্ভবতী ভাতার টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উদ্যোক্তার
পুঠিয়া প্রতিনিধি:
রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার জিউপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা ওয়াসিমের বিরুদ্ধে গর্ভবতী ভাতা কর্মসূচির আওতায় ভাতাভোগীর নগদ একাউন্ট নম্বর ইচ্ছাকৃতভাবে পরিবর্তন করে অন্য নম্বরে অর্থ পাঠানোর অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ জনতা গত সোমবার (২৬ মে) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে উদ্যোক্তা ওয়াসিমের ওপর হামলা চালায়। যেখানে পরিষদের ভেতরে ধাক্কাধাক্কি, উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় এবং ওয়াসিম দোষ এড়ানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হন।
ভুক্তভোগী সেনভাগ ম্যাচপাড়া গ্রামের জহুরুল ইসলামের স্ত্রী শামীমা খাতুন জানান, গর্ভবতী ভাতা পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, ছবি এবং নিজস্ব নগদ একাউন্টের মোবাইল নম্বরসহ আবেদনপত্র ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে জমা দেন। পরবর্তীতে ভাতার টাকা না পেয়ে তিনি পরিষদে গিয়ে জানতে পারেন, তার দেওয়া নম্বর পরিবর্তন করে অন্য একটি নাম্বার ব্যবহার করা হয়েছে, যেখানে নিয়মিত টাকা যাচ্ছে। শামীমা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সংসারে অভাব-অনটনের মধ্যে সরকারি ভাতার টাকাটুকুই ছিল ভরসা, অথচ ওয়াসিম প্রতারণা করে সেই টাকা অন্যজনকে পাইয়ে দিচ্ছে।
ঘটনার দিন পরিষদের ভেতরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। শামীমা এবং তার স্বজনেরা বিষয়টির প্রতিবাদ করলে ওয়াসিমের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কির মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। ওয়াসিম বারবার দাবি করে মোবাইল নম্বর সে পরিবর্তন করেনি, বরং মহিলা বিষয়ক দপ্তর নম্বর এডিট করেছে। তবে উপস্থিত অনেকে ওয়াসিমের এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে সরাসরি তাকে দায়ী করেন।
এ ঘটনার পর অনুসন্ধানে উঠে আসে, শুধু শামীমা খাতুন নয়—জিউপাড়া ইউনিয়নের আশপাশের অন্তত দুই শতাধিক ভাতাভোগী একই ধরনের হয়রানির শিকার হয়েছেন। মাতৃত্বকালীন, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী, বিধবা ভাতাসহ বিভিন্ন সরকারি সেবার জন্য মানুষ ডিজিটাল সেন্টারে গেলে ওয়াসিম নিয়মিত অতিরিক্ত অর্থ দাবি করেন এবং সরকারি রশিদ বা কোনো ভাউচার ছাড়াই টাকা আদায় করেন বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা। অনেক সময় ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল করে পরে তা সংশোধনের নামে আরও টাকা আদায় করেন বলেও ভুক্তভোগীদের অভিযোগ।
পরিষদের দীর্ঘদিনের পরিচ্ছন্নতা কর্মী সীতা রানী বলেন, আমি এক যুগেরও বেশি সময় এখানে কাজ করছি, কে কী করে সব চোখের সামনে দেখি। ওয়াসিম টাকা ছাড়া কোনো কাজ করে না—এটা পরিষদের সবাই জানে। ইচ্ছা করে ভুল করে, আবার টাকার লোভে ঠিক করে দেয়। এ রকম ঘটনায় বহুবার সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে এসেছে, এমনকি মানববন্ধনও করেছে, কিন্তু তাতেও তার স্বভাব বদলায়নি।
একজন সেবা প্রত্যাশী সবুজ বলেন, এই উদ্যোক্তার ব্যবহার এতটাই খারাপ যে, সাধারণ মানুষকে মানুষই মনে করে না। কথাবার্তায় এমন ভাব দেখায় যেন সে ইউনিয়নের সচিবের চেয়েও বড় কেউ। অপর এক ভুক্তভোগী মিজানুর রহমান বলেন, আমার সব ডকুমেন্ট ঠিক থাকার পরেও ওয়াসিম ইচ্ছা করে ভুল করেছে। পরে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে ঠিক করেছে, এটা ছিল পুরোপুরি ঠকবাজি।
পরিষদের এক গ্রাম পুলিশ, যিনি নিজের নাম প্রকাশ করতে চাননি, বলেন, এ ধরনের ঘটনা নতুন নয়। ৫ আগস্টের আগ থেকেই এসব হচ্ছে। কেউ কিছু বলত না, কারণ ওয়াসিম চেয়ারম্যানের খুব ঘনিষ্ঠ ছিল। এখন আবার বিএনপির কিছু নেতার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছে, তাই অনেকেই মুখ খুলতে ভয় পায়। আমরা তো চাকরি করি, মুখ খুললেই বিপদ।
এ বিষয়ে উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মোছা: শাহিনুর খাতুন বলেন, আমি বিষয়টি জানি। ওয়াসিম আমার কাছে এসে ভুল স্বীকার করেছে। আমি ইউএনও স্যারের সঙ্গে আলাপ করেছি। তিনি জানিয়েছেন, ব্যবস্থা নেওয়া হবে, আমার ব্যক্তিগত মত হলো—এ ধরনের উদ্যোক্তারা পরিষদে না থাকলেই ভালো, তারা যেমন আমাদের অফিসের সুনাম নষ্ট করছে, তেমনি সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে পরিষদের পরিবেশও নষ্ট করছে।
জানা গেছে, বর্তমানে জিউপাড়া ইউনিয়ন পরিষদে কোনো নির্বাচিত চেয়ারম্যান নেই। সেই কারণে অস্থায়ীভাবে পরিষদের দায়িত্ব পালন করছেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা স্মৃতি রানী সরকার। এ অবস্থায় দীর্ঘদিন ধরেই ইউনিয়নের ডিজিটাল সেন্টারে কোনো কার্যকর তদারকি নেই।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা স্মৃতি রানী সরকার বলেন, বিষয়টি আমার জানা আছে। আমি অভিযুক্ত ওয়াসিমসহ সংশ্লিষ্টদের ডেকে কথা বলেছি। তদন্ত প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তদন্তে যদি অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তাহলে প্রশাসনিকভাবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
স্থানীয় সচেতন মহল মনে করছেন, একজন উদ্যোক্তার দুর্নীতির কারণে শুধু ইউনিয়ন পরিষদেরই নয়, সরকারি সেবা ব্যবস্থার ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা নষ্ট হচ্ছে। তারা অবিলম্বে ওয়াসিমকে অপসারণ করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন, যাতে ভবিষ্যতে কেউ ডিজিটাল সেবা কেন্দ্রকে ব্যক্তিগত লোভের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করার সাহস না পায়।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন