ব্যবসায়িক রাজনীতি, নাকি রাজনৈতিক ব্যবসা?
পদপদবী প্রাপ্ত নেতার আচরণে আমরা ব্যথিত, আমরা ক্ষুব্ধ ক্ষতবিক্ষত!!
------------------------------------------------------
মোঃ হাসানুর জামান বাবু
বেশ কয়েকদিন থেকেই ব্যবসায়িক রাজনীতি ও রাজনীতির ব্যবসা শব্দগুচ্ছদ্বয় মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। বৈশাখ মাসের এই প্রচন্ড গরমের দাপটে শব্দযুগল মাথার মধ্যে আরও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। এ দেশের রাজনীতির ধারা পরিবর্তনে শব্দযুগলের পরিষ্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন।
এ পরিষ্কার ধারণা রাজনীতিকরাই দিতে পারেন। তারাই এ চলতি অবস্থার প্রবর্তক, ধারক ও বাহক। তবে একথা সত্য যে, এদেশের রাজনীতির বেশিরভাগটাই পচে নষ্ট হয়ে গেছে। এ দিগ্ভ্রান্ত-লক্ষ্যভ্রষ্ট রাজনীতি দিয়ে এ দেশের মুক্তিকামী শান্তিপ্রিয় মানুষের ভালো কিছু আশা করা পশ্চিম গগনে অন্ধবেগে ধেয়ে-আসা কালবোশেখি ঝড়ো মেঘের কাছে শ্রাবণঘন অবিরাম-ঝরা শ্রান্ত-মেদুর বর্ষা চাওয়ার শামিল।কেননা নিজের প্রায় বত্রিশ বছরের রাজনৈতিক জীবনে নিজের দলের নেতাকে টাকা লেনদেনের বিনিময়ে কোন কাজ করানোর অভিজ্ঞতা পূর্বে ছিলো না কখনোই। কিন্তু লজ্জার বিষয় একজন কর্মী সমর্থক হয়েছেও একজন মিডিয়া কর্মী সচেতন নাগরিক হয়েও সম্প্রতি নিজ দলের পদপদবী প্রাপ্ত একজন নেতার কাছে আবদার অধিকার নিয়ে গিয়েছিলাম দুটি কাজের সুপারিশ করাতে। কাজের কাগজপত্র হাতে নিয়েই নেতা জানতে চাইলেন টাকা কতো দিতে পারবেন? আমার হতবিহ্বল অবস্থা দেখে নেতা নিজেই বলে দিলেন দুটি কাজের মধ্যে একটি করতে হলে তিনলক্ষ টাকা লাগবে আর অপরটি লাগবে পঞ্চাশ হাজার টাকা।সব টাকা একসাথে নিতে না পারলে কয়েকদিন সময় নিয়ে কিস্তি করে দেওয়ার সুযোগ আছে।কাজ দুটিই আমার কাছে জরুরি বিধায় অনেক ভেবে চিন্তে ইজ্জৎ সম্মান রক্ষা করতে নেতার উপর শতোভাগ আস্হা রেখে তিন কিস্তি করে নেতার হাতে নিজেই সর্বমোট দু’লক্ষ চল্লিশ হাজার টাকা দিয়ে খুবই বিনয়ের সাথে বললাম মহাশয় আমার প্রথম পরিচয় আমি একজন প্রবীণ আপনার দলের কর্মী। আর আমার ২য় পরিচয় আমি একজন মিডিয়া কর্মী। আমার কাজ গুলো হবে তো!?নেতা অফিসে টেবিলে থাপ্পড় মেরে বললেন ২০০% গ্যারান্টি কাজ হবে।
নেতার কথাবার্তায় বিশ্বাস করে পনের বিশ দিন অপেক্ষা করে জানতে পারলাম আমার দেওয়া দুটি কাজের মধ্যে একটিও হয়নি। যেহেতু ইতিপূর্বে নিজ দলের নেতাকে টাকা লেনদেনের বিনিময়ে কোন কাজ করানোর অভিজ্ঞতা আমার ছিলো না। তাই সরল মনে বিশ্বাস করেই আশায় বুক বেঁধে ছিলাম। আমার আশা যে গুড়ে বালি হবে কখনো কল্পনাও করেনি।যাই হোক কাজ তো হলোনা এখন নিজের চক্ষু লজ্জায় টাকা গুলো ফেরত চাইতেও পারছিনা।তারপরও অনেক ভয়ে ভয়ে একবার নেতার একজন ক্যাশিয়ার কে দিয়ে বললাম আমার কাজতো হলোনা এখন টাকা গুলো ফেরত কখন দিবে? নেতার ক্যাশিয়ারে মুখের ভাষা শুনে আমি তিনদিন বেহুঁশের মতো ছিলাম। এখনো টাকা কিন্তু ফেরত পায়নি। এই হলো রাজনীতি।
রাজনীতি এ দেশের অনেক অনিষ্টের আঁতুড়ঘর। রাজনীতিকে সুষ্ঠু ধারায় নিয়ে আসা এ দেশের সামনে এক বড় চ্যালেঞ্জ। মানুষের স্বভাব একবার নষ্ট হয়ে গেলে কদাচিৎ আবার ভালো পথে ফিরে আসে।
সামনে নির্বাচন। বাজারে রাজনীতির ধারা পরিবর্তনের কথা উঠছে। তাই আমার মাথায়ও বিষয়টি ঘুরপাক খাচ্ছে। সেদিন তো এক লেখায় ইনিয়ে-বিনিয়ে বলেই ফেলেছি, এদেশে রাজনীতিই আমাদের মূল সমস্যা এবং দেশের জন্য একটা বিপদও বটে। কথাটা কিন্তু সর্বাংশে সত্য।
‘রাজনীতি’ একটা ভালো শব্দ, এটাকে আমরা পচিয়ে ফেলেছি। রাজনীতির বিষবাষ্প আমাদের সামাজিক শিক্ষা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, অফিস-আদালত-প্রশাসন, নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ, অর্থব্যবস্থাকে ক্রমেই ধ্বংস করে ফেলছে। একথা সবাইকে মানতেই হবে। এটা দলীয় তর্কের ঊর্ধ্বে। এটাকে আগে মেরামত করা দরকার। আমরা আগেভাগে বেশি কিছু বলতে গেলেই কমেডিয়ানের কৌতুকের মতো কেউ আবদার ধরে বসেন, ‘কলা ছুললে ক্যানো, বুজিয়ে দেও’। কলার চোঁচাঁ ছেলা ছাড়া যে খাওয়া যায় না, এটা আমরা কেউ কেউ বুঝতে চাই না। ছেলা কলা বোজানোও যায় না। আবার আমরা কখনো-সখনো এসব কথা বুঝেও না বোঝার ভান করি। এখানেই যত বিপত্তি। ‘তোরা যে যা বলিস ভাই আমার সোনার হরিণ চাই।’
আসলে কথাটা ‘ব্যবসায়িক রাজনীতি’ নাকি ‘রাজনীতির ব্যবসা’ তা আমার কাছেও পরিষ্কার নয়। তাই এ দুটো শব্দগুচ্ছের অবতারণা। এ দেশে এসব কেন জানি গোলমেলে হয়ে গেছে। শব্দযুগল হতে পারে সমার্থক অথবা ভিন্নার্থক। এ নিয়ে মাথাটা আমি বেশি ঘামাতে চাচ্ছি না। শব্দগুচ্ছদ্বয়ের বাস্তব প্রয়োগ এ দেশে পুরোপুরি হচ্ছে দেখে উদ্বেগ বাড়ছে তাই।
সকালেই একটা পত্রিকায় খবরের হেডলাইনটা এরকম পড়লাম : ‘সরকারি সার/৫৮২ কোটি টাকার সার আত্মসাৎ’। খবর থেকে জানলাম, সার আত্মসাৎকারী প্রতিষ্ঠানের মালিক সাবেক সংসদ-সদস্য ও সার সমিতির সভাপতি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দাবি, তিনিই মূলত দেশে সারের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। রাজনীতি এখন ব্যবসার টাকার কাছে নতজানু হয়ে গেছে। রাজনীতি এখন টাকা কামানোর হাতিয়ার, আইনকে বুড়ো আঙুল দেখানোর রক্ষাকবচ। অনেক ব্যবসায়ী অবৈধ পথে ব্যবসা করছেন, আবার রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করছেন। রাজনৈতিক তরিকা মোতাবেক কাজ করছেন।
কোথাও কোথাও সরাসরি রাজনীতিও করছেন। আমি একথা বলছি না যে, ব্যবসায়ীরা রাজনীতি করতে পারবেন না। বিষয়টি হচ্ছে, অনেক ব্যবসায়ীই ব্যবসায় রাজনৈতিক পুঁজি খাটাচ্ছেন। অতি অল্প সময়ে অঢেল টাকার মালিক হচ্ছেন। রাজনৈতিক দাপট দেখিয়ে যা খুশি তা-ই করছেন। ভাবছেন না এতে কার লাভ, কার ক্ষতি। দেশের আর্থিক সুবিধাকে শুষে পকেটে ভরছেন। এদের বিচার-আচারও সহসা হয় না। খোদা-না খাস্তা, বিচারের আওতায় আনা হলেও বিষয়টি বিচারের দীর্ঘসূত্রতার ফাঁদে ফেলে কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। এটিও এক ধরনের প্রহসন।
সম্প্রতি দেখছি অনেক নেতা পদপদবী পাওয়া মাত্রই এটাকে ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করেছে। এটাকে রাজনীতি বলব, নাকি রাজনীতির ব্যবসা বলব? কার লাভ পাঠকমহল ভালো জানেন। কার ক্ষতি এটাও প্রতিটা ভাত-খাওয়া লোক ভালো করেই বোঝেন। আবার দেশব্যাপী অধিকাংশ পণ্যের ভেজালের মহোৎসব চলছে। ব্যবসার মাঠে নীতি-নৈতিকতার বড্ড খরা চলছে। ব্যবসায়ীদের ইমান-আমান, মূল্যবোধ, হালাল পেশার অহংকার এ খরায় ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। আমার প্রশ্ন, এভাবে কি একটা দেশ চলা উচিত?
আমার অনেক শুভার্থী রাজনীতিতে ঢুকেছে। বেশ ভালোই করছে। তাদের কাছে অনেক কথাই শুনি। ছোটবেলা থেকে বইপত্রে পড়ে আসছি, রাজনীতি মানে জনসেবা, সমাজসেবা, দেশসেবা, নিজের স্বার্থকে মানুষের জন্য ত্যাগ করা-এমন অনেক কিছু। রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্রেও হয়তো তা-ই লেখা আছে। আমার সাথে শুভার্থী অনেকেই খোলামেলা কথা বলে। রাজনীতির বাস্তবতা ভিন্নরূপ। রাজনীতি করতে হলে মিথ্যা বলা ও টাকা ছাড়া নাকি এক পাও এগোনো যাচ্ছে না। পদ পেতে গেলেও টাকা, নির্বাচনে প্রার্থী হতে চাইলেও টাকা, নির্বাচন করতেও টাকা।আবার কোন কাজে সুপারিশ করতে হলেও টাকা,কাউকে মেম্বার চেয়ারম্যান বানাতে গেছে টাকা। আবার নির্বাচনে পাশ করেও টাকা কুড়ানোর আম-ধরাধরির খেলা। বর্তমানে রাজনীতিই একটা টাকার খেলা। অঢেল টাকা কামানোর জন্য রাজনীতি কিংবা রাজনীতির জন্য টাকা-দুটো কথাই এ দেশে সমভাবে খাটে। এ নিয়ে আমার মতো চুনোপুঁটির কিছু করার নেই, তাই দু-এক কথা লিখে সান্ত্বনা খুঁজি। এ দেশের নেতারা শতকরা কত ভাগ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তার একটা খতিয়ান টিআইবি কয়েক বছর আগে গবেষণার ফল হিসাবে দিয়েছিল। সে হিসাব এক বছরে ভুলে গেছি। জানতে ইচ্ছে করে, এ দেশে রাজনীতি কি বর্তমানে একটা পেশা, নাকি ব্যবসা? নাকি ব্যবসা ও পেশা দুটোই? কোনো কোনো কর্মী ব্যবসায়িক রসিকতা করে বিজ্ঞাপনের সুরে বলে, ‘কী লবণ দেবেন? লবণের আবার রকম কীয়ের? ভালো-মন্দ দুইট্যাই আছে।’ আরও জানতে ইচ্ছা করে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বইতে রাজনৈতিক দলের যে কার্যাবলি পড়েছিলাম, সেগুলো কি ভুলে যাব? আমি গ্রামের মানুষ। গ্রামে-গঞ্জে সব জায়গাতেই ছাত্রদের কথার সত্যতা পাচ্ছি, রাজনীতি একটা রমরমা ব্যবসা। মিথ্যার বেসাতি। লাঠিয়াল বাহিনী পোষার ব্যবসা। নিজের চোখ ও কানকে তো আর অবিশ্বাস করতে পারিনে!
কোনো রাজনৈতিক দল বা কোনো দলীয় জোট নির্বাচনের আগে ক্ষমতায় গেলে তারা দেশের উন্নতি ও জনকল্যাণের জন্য কী কী ব্যবস্থা নেবে, কীভাবে নেবে-সবটুকুই এ দেশের নাগরিকদের পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লিখিত ও দফা আকারে জানাতে হবে। ভোটাররা সবকিছু বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখবেন। ভোট দেবেন রাজনৈতিক আদর্শ দেখে নয়, কর্মসূচি ও কর্মপদ্ধতি দেখে, সম্পদ লুটতরাজ করা লোকের কর্মসম্পৃক্ততা দেখে। রাজনীতিতে কি বর্তমান ধারাই থাকবে, নাকি নতুন কোনো ধারার প্রবর্তন করা হবে? জানা দরকার, ভোটব্যবস্থায় নিজের ভোট নিজে দেওয়ার সুব্যবস্থা থাকবে, না থাকবে না? অনেক কিছুই জানা দরকার। আমাদের যেহেতু কোনো ফোরাম নেই, পত্রিকার মাধ্যমেই আমরা প্রয়োজনীয় কিছু কথা জিজ্ঞেস করতে পারি। দেশের মানুষ নির্বাচনের পরও কাজের সঙ্গে কথা মিলিয়ে দেখে পরবর্তী দিনের সিদ্ধান্ত নেবে।
সেক্ষেত্রে বিএনপির প্রকাশিত ৩১ দফার পরিবর্তে তাদের আরও বিস্তারিত কথা বলতে হবে। অনেক বিষয় আছে, যা না বলা রয়ে গেছে। দেশের সামাজিক শিক্ষা ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা কেমন হবে, ব্যবসায়িক রাজনীতির অস্তিত্ব থাকবে, নাকি ঢেলে সাজাতে হবে; রাজনীতিকরা আধুনিক ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যাবেন, নাকি দেশসেবা-সমাজসেবার ওল্ড মডেল (?) নীতি আঁকড়ে ধরে সামনে এগোবেন-সব কথা খোলামেলা জানাতে হবে। এ দেশের নিকষ-কালো রাজনীতিকে কীভাবে খোলনলচে বদল করে ভালো করা হবে সে কথাও লিখতে হবে। গলাটা একটু ঝেড়ে কাশতে হবে। সব কথাই লিখিতভাবে প্রকাশ করতে হবে। সব রাজনৈতিক দলও তাদের দেশ পরিচালনার নীতিমালা-কর্মসূচি নিয়ে জনগণের সামনে আসতে পারে। দলীয় কর্মপদ্ধতি ও ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা তুলে ধরতে পারে। কীভাবে নির্বাচন করতে চায় তা আগে আগে বলতে পারে। দলীয় সংঘাত এড়িয়ে যেতে পারে। দলীয় রাজনীতির অধীনে নির্বাচন হলে সে নির্বাচন কেমন হবে-এটি সাধারণ মানুষের কাছে ওপেন সিক্রেট। ‘আগুনে যার ঘর পুড়েছে সিঁদুর-রাঙা মেঘ দেখে তার ভয়।’ এ নিয়ে অযথা তর্কাতর্কি ও বিবাদ-বিসম্বাদ না করাই ভালো। তারা অনেক অনেক অবকাঠামোগত উন্নতি করেছে, এগুলো জনসমক্ষে তুলে ধরতে পারে।
ফার্সি ভাষার নামকরা এক কবির একটা কবিতা পড়েছিলাম। সারকথাটা এরকম : বিড়ালের যদি পাখা গজাতে দেওয়া হতো, তাহলে ঘরের চালে বসবাসকারী শান্তিকামী চড়ুইপাখিগুলোর জীবনসংহার হয়ে যেত। এ দেশের সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা ও কল্যাণের স্বার্থে বিড়ালের পাখা গজাতে দিতে আমরা রাজি নই। এ দেশের প্রতিটি সচেতন মানুষের এ বোধোদয় যত তাড়াতাড়ি হয়, ততই সবার জন্য মঙ্গল। সব রাজনৈতিক দলীয়প্রধানের কাছে আমাদের অনুরোধ, তারা যেন কোনোভাবেই বিড়ালের পাখা গজাতে না দেন।
লেখক:- মোঃহাসানুর জামান বাবু
মিডিয়া কর্মী ক্রীড়া সংগঠক ও
রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন